দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। জাতিসঙ্ঘের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী এটি একটি স্বল্পোন্নত দেশ (Least Developed Country)। শিল্প ও সেবা খাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ সত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অদ্যাবধি কৃষিনির্ভর কারণ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষিজীবী। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে পারিবারিকভাবে, বিশেষ করে খামারে গবাদি প্রাণি যেমন- গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া এবং হাঁস-মুরগি প্রতিপালন যেকোনো দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এসব প্রাণি, কৃষি কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কাজে চালিকা শক্তি, চামড়া ও সার এবং জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের জন্য মাংস ও দুধের সরবরাহের প্রধান উৎস।
বাংলাদেশের শতকরা ৮৩.৯ ভাগ পরিবার প্রাণি-পাখি প্রতিপালন করছে। তবে শুধু গরু-মহিষ প্রতিপালন করছে শতকরা ৪৫.৯ ভাগ পরিবার। এ ছাড়া ছাগল-ভেড়া প্রতিপালন করছে শতকরা ৩১.৪ ভাগ এবং হাঁস-মুরগি শতকরা ৭৬.৩ ভাগ পরিবার। প্রাণিসম্পদ, ভূমিহীন মানুষের জীবিকার একটা বড় অবলম্বন। বর্তমানে এ দেশে ২৫.৭ মিলিয়ন গরু, ০.৮৩ মিলিয়ন মহিষ, ১৪.৮ মিলিয়ন ছাগল, ১.৯ মিলিয়ন ভেড়া, ১১৮.৭ মিলিয়ন মুরগি এবং ৩৪.১ মিলিয়ন হাঁস রয়েছে।
প্রাণিসম্পদের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে জড়িত রয়েছে গবাদি প্রাণির স্বাস্থ্য ও কল্যাণ, উৎপাদন উপাত্তগুলির মান এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসা-উদ্যোগ প্রসারের কার্যকর ব্যবস্থা। পরিসংখ্যান অনুসারে মোট জাতীয় উৎপাদের (জিডিপি’র) প্রায় ২.৯% যোগায় প্রাণিসম্পদ খাত এবং এটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫%। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা বা পরজীবী প্রাণীর সংক্রমণ অথবা বিপাক ক্রিয়ায় ভারসাম্যের ত্রুটির কারণে গবাদি প্রাণির স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। তদুপরি, আপাতদৃষ্টিতে স্বাস্থ্যবান একটি প্রাণির ভালো প্রজনন স্বাস্থ্য থাকবে এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই। প্রজননক্ষমতা লোপ, গর্ভধারণে ব্যর্থতা, ভ্রূণাবস্থায় মৃত্যু ও গর্ভপাত এবং স্ত্রী প্রাণির অন্যান্য রোগের সঙ্গে প্রায়শ দুর্বল প্রজনন কর্মকান্ড সম্পর্কিত থাকে। প্রজনন ও স্বাস্থ্যে ব্যাঘাত ঘটায়, এরকম একটি রোগের নাম ব্রুসেলোসিস (Brucellosis)। এটি মূলত একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ যা Brucella spp. (ভেড়ার ক্ষেত্রে Brucella melitensis ও Brucella ovis) দ্বারা হয়।
এ রোগের ফলে গর্ভবতী ভেড়ার গর্ভাবস্থার শেষভাগে Abortion বা গর্ভপাত হয়। গর্ভচ্যুত বাচ্চা জীবিত থাকলেও খুব দুর্বল হয় অথবা জন্মের কয়েক ঘন্টা পরই মারা যায়। অনেক সময়ই গর্ভফুল আটকে যায় এবং পরবর্তীতে জরায়ুর প্রদাহ লক্ষ্য করা যায়। ফলশ্রুতিতে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে ভেড়ীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। আবার দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ থেকে দুধ উৎপাদন হ্রাস, বন্ধ্যাত্ব এবং বার বার গরম হওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পায়। প্রজনন কাজে ব্যবহৃত পুরুষ ভেড়ার ও এ রোগ হয়ে থাকে। ব্রুসেলা জীবাণু সংক্রমণের ফলে পুরুষ ভেড়ায় অর্কাইটিস, এপিডিডাইমাইটিস ও অন্যান্য জনন অঙ্গ এবং গ্রন্থির প্রদাহের ফলে এসব অঙ্গ স্ফীত ও ব্যাথাপূর্ণ হয়ে উঠে। এই আক্রান্ত পুরুষ ভেড়া বা ভেড়ীর সাথে অনাক্রান্ত ভেড়ী বা ভেড়ার প্রজননের মাধ্যমে ব্রুসেলা জীবাণু ছড়াতে থাকে। তাছাড়াও একবার যদি কোন খামার ব্রুসেলোসিস দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে সম্পূর্ণ খামারেই এ রোগের বিস্তার হতে পারে।
তবে, এই ব্রুসেলোসিস এর সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে, আক্রান্ত প্রাণী থেকে মানবদেহে এ রোগের বিস্তার (Zoonotic Disease)। আক্রান্ত প্রানীর কাঁচা বা স্বল্প জ্বাল দেয়া দুধ পান, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরন, মল-মুত্র অথবা দেহ নিঃসৃত অন্যান্য পদার্থের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ (কসাই, প্রানী প্রজননকর্মী বা চিকিৎসক) সংস্পর্শ থেকে মানুষ ও শিশুদের এ রোগ হতে পারে। ব্রুসেলোসিস সংক্রমিত মানবদেহে পেশী ও জয়েন্টে প্রদাহ, দৈহিক দুর্বলতা, মাথা-ধরা, প্লীহা ও যকৃতের আকার বেড়ে যাওয়া, জ্বর উঠানামা করা ও রাতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া প্রভৃতি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এই রোগের জীবাণু অন্তঃকোষীয় হওয়ায়, এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করেও তেমন ফল পাওয়া যায় না। তবে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ১০ মিলিগ্রাম/ কেজি দৈহিক ওজন হিসেবে ৩-৪ দিন এবং স্ট্রেপ্টোমাইসিন ৫ মিলিগ্রাম/ কেজি দৈহিক ওজন হিসেবে প্রত্যেহ একবার করে ৫ দিন ভেড়ার মাংসপেশীতে দিলে উপকার পাওয়া যায়।
ব্রুসেলোসিস নিয়ন্ত্রনের জন্য আক্রান্ত প্রাণী সনাক্তকরন ও মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলা (আক্রান্ত প্রানীর জন্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র, এবং নিঃসৃত পদার্থসহ) সবচেয়ে উত্তম। এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিন কোরিয়া বিভিন্ন ভ্যাকসিন বা টীকা (ব্রুসেলা মেলিটেনসিস স্ট্রেইন – ১৯, লাইভ ভ্যাকসিন) ব্যবহার করলেও বাংলাদেশে এখনো এ রোগের জন্য কোনো ভ্যাকসিন দেয়া হয় না। বাংলাদেশেও উক্ত ভ্যাকসিন ব্যবহার করে আমাদের প্রানীস্বাস্থ্য ও মানবস্বাস্থ্যের বিভিন্ন ক্ষতিসাধন থেকে মুক্তিসহ প্রানীসম্পদের এই সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়ন সম্ভব।
সূত্রসমুহঃ
• DLS, 2014. Brucellosis in Bangladesh. www.dls.gov.bd/
• http://bn.banglapedia.org
• Rahman, M.S., Faruk, M.O., Her, M., Kim, J.Y., Kang, S.I., & Jung, S.C Prevalence of brucellosis in ruminants in Bangladesh; Veterinarni Medicina, 56, 2011 (8): 379–385.
• A textbook of “Animal Husbandary and Veterinary Science”, V-II; by Professor M. A. Samad.
No comments:
Post a Comment