বেশ কিছু বছর ধরেই এশিয়ায় প্রাণিবাহিত রোগের প্রকপ বৃদ্ধি পেয়েছে - এভিয়ান ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, জলাতংক, নিপাহ ভাইরাস’র পর সম্প্রতি দেখা দিয়েছে অ্যানথ্রাক্স। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। যেসব রোগ প্রাণি-পাখি হতে বিভিন্ন মাধ্যমে মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করে সেসব রোগকে বলা হয় জুনোটিক রোগ (Zoonotic Disease)। অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা বা ব্ল্যাক ব্লাড তেমনই একটি প্রাণিবাহিত জুনোটিক রোগ যা একাধারে গবাদিপ্রাণী ও মানুষে রোগ সৃষ্টি করে জনজীবনে আতংক তৈরী করে চলেছে।
অ্যানথ্রাক্স কি ?
অ্যানথ্র্যাক্স’ একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ কয়লা। কারণ অ্যানথ্রাক্স রোগীর চামড়ায় যে ক্ষত হয় তা কালো ছাইয়ের মতো দেখায়। যে জীবাণু দ্বারা রোগটি হয় তার নাম ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস(Bacillus anthracis)। এটি একধরণের গ্রাম পজিটিভ রড আকৃতির ব্যাক্টেরিয়া। জীবাণুটি বিভিন্ন রকমের টক্সিন তৈরি করতে পারে যাদের এক্সোটক্সিন বলা হয়। এই টক্সিনগুলোই বিভিন্ন রকমের রোগ এবং রোগজনিত জটিলতার জন্য দায়ী। আর, রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গরু মারা যায়। অনেক সময় লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পরপরই গরু মারা যেতে পারে ফলে চিকিৎসার কোনো সুযোগই পাওয়া যায় না। এমনই মারাত্মক ব্যাধি অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ এবং পাবনার কয়েকটি থানায় এ রোগটি দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে অনেক গরু, মারাও গেছে বেশ কিছু। সিরাজগঞ্জ বা পাবনা’তেই যে এ রোগ প্রথম দেখা দিয়েছে তা নয়। অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগের ইতিহাস অনেক পুরনো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯১ সালেও মিসরে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল বলে জানা যায়। শুধু মিসর নয়, গ্রিস, রোম এমনকি ভারতবর্ষেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে এ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকায় ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার রেকর্ড রয়েছে। এমনকি মাত্র তিন দশক আগে ১৯৭৮-৮০ সালে জিম্বাবুয়েতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে শুধু প্রাণী নয়, প্রায় দশ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়, মারা যায় প্রায় ১৫১ জন। প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ২০০০ মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে থাকে যার মাঝে গড়ে ২ জন থাকে আমেরিকার।
অ্যানথ্রাক্স এর বিস্তৃতিঃ
আমেরিকা (উত্তর), ইউরোপে অ্যানথ্রাক্স এর প্রকোপ অনেক কম। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য-সহ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল,আফ্রিকা এবং ল্যাতিন আমেরিকায় এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ্যণীয়। জীবাণুযুদ্ধে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ব্যবহৃত হয়; চিঠি বা প্যাকেটের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স স্পোর ছড়িয়ে দেয়া হয় অথবা বড় পরিসরে ছড়ানোর জন্য অ্যানথ্রাক্স জীবাণু এরোসল আকারে স্প্রে করা হয়। মূলত গরুতে এ রোগ বেশি প্রকাশ পায়, তবে ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, মহিষ, জেব্রা, জিরাফ, হরিণ, শূকর, হাতি এবং বানরও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মাংসাশী প্রানী যেমন কুকুরে আক্রান্ত মাংস সেবনের মাধ্যমেই অ্যানথ্রাক্স হয়ে থাকে। সাধারণত, পাখিদের এ রোগ হয় না। প্রাণী থেকে মানুষে এ রোগ ছড়ায় বলেই ভয়ের কারণটা একটু বেশি। মানুষের ত্বকের মাধ্যমে সাধারণতঃ অ্যানথ্রাক্স জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু ত্বকে যদি অতিক্ষুদ্র ক্ষতও থাকে তবে জীবাণু ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। যে কোন বয়সের, শ্রেণীর এবং লিঙ্গের মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হতে পারে। অ্যানথ্রাক্স বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই গবাদিপ্রাণীর লালন-পালন, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং প্রাণীজাত দ্রব্যাদির শিল্প (যেমন-ট্যানারী, মিট-মিল/ বোন-মিল প্রস্তুতকারক প্রভৃতি) সম্পর্কিত মানুষের বেশী হয়, এজন্য তরুণ এবং মধ্যবয়সী কর্মক্ষম মানুষের এ রোগ বেশী হয়। আবার অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশুর মাংস কাটাকাটি বা খাওয়ার মাধ্যমে যে কারও এ রোগ হতে পারে, কারণ স্বাভাবিক রান্নার তাপে অ্যানথ্রাক্স স্পোর নষ্ট হয় না।
অ্যানথ্রাক্স যেভাবে ছড়ায়ঃ
অ্যানথ্রাক্স মূলত তৃণভোজী পশুর রোগ। ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস (B. anthracis) ব্যাকটেরিয়াটি স্পোর বা শক্ত আবরণী তৈরি করে অনেক বছর (প্রায় ৬০ বছর) পর্যন্ত মাটিতে বেঁচে থাকতে পারে। মূলত, ঘাস খাওয়ার সময় গবাদিপ্রাণী এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত গবাদিপ্রাণীর সংস্পর্শে এলেই কেবল মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। অসুস্থ গবাদিপ্রাণীর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদির সংস্পর্শের মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণি এবং মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এটি মূলত চারটি উপায়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে যেমন- ত্বক (ক্ষত), শ্বসনপ্রণালী, খাদ্যনালী (ক্ষুদ্রান্ত্র) ও ইনজেকশন এর মাধ্যমে।
অ্যানথ্রাক্স কোথাও একবার এ রোগ দেখা দিলে তা পরবর্তী সময়ে আবারো দেখা দিতে পারে। ট্যানারি বর্জ্যরে সঠিক ও সুষ্ঠু নিষ্কাশন এ জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। অ্যানথ্রাক্সে মৃত গরুর চামড়া ট্যানারিতে গেলে তা থেকে জীবাণু চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভয়াবহ অবস্খার সৃষ্টি হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়।
প্রাণীতে অ্যানথ্রাক্সের লক্ষনসমুহঃ
B. anthracis ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট হল, এরা প্রতিকুল পরিবেশেও Spore হিসেবে অনেকদিন থাকতে পারে এবং অনূকুল পরিবেশে পরবর্তীকালে তারা রোগের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়। পশু অথবা মানুষের শরীরে জীবাণু প্রবেশের পর রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে ১-২ সপ্তাহের মত সময় লাগে। তবে, বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ফুসফুস সংক্রমিত হলে অতি অল্প সময়ে তার লক্ষন পরিলক্ষিত হতে পারে।
অ্যানথ্রাক্স এর উল্লেখযোগ্য লক্ষণসমুহ হলো-
• অত্যাধিক জ্বর হয় (১০৩০-১০৭০ ফাঃ)
• শ্বাসকষ্ট এবং দাঁত কটকট করে
• শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠে
• প্রাণীকে কিছুটা উত্তেজিত দেখায়
• আক্রান্ত প্রাণী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে
• প্রাণী নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ে
• লেজ দিয়া মশা মাছি তাড়াবে না
• খিঁচুনি হয় ও অবশেষে প্রাণী মারা যায়
• অনেক সময় লক্ষণসমূহ প্রকাশের আগেই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে
• মৃত প্রাণীর পেট দ্রুত ফেঁপে যায়
• মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বা পরে প্রাণীর নাক, মুখ, কান, মলদ্বার ও যোনিপথ দিয়ে আলকাতরার মত কাল রঙয়ের রক্ত বের হয়
• এই রোগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – প্রাণী মারা যাওয়ার পর কখনো জমাট বাঁধে না।
মানুষে লক্ষণসমূহঃ
মানুষে এই ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর সুপ্তিকাল বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড দুই থেকে সাত দিন। এটি প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়; কিন্তু মানুষ থেকে মানুষে সরাসরি ছড়ায় না এর মানে হলো আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে একজন মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এলে অন্য আরেকজন মানুষ আক্রান্ত হবে না।
অ্যানথ্রাক্স জীবাণু মানুষের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্ত অঙ্গ অনুযায়ী রোগের ধরনও বিভিন্ন রকম হয়। যেমনঃ
১। ত্বকের (Cutaneous) অ্যানথ্রাক্সঃ শরীরের অন্যান্য অংশের চেয়ে ত্বক-ই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়, প্রায় ৯৫ শতাংশ। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত প্রাণী অথবা অ্যানথ্রাক্স স্পোর দ্বারা দূষিত প্রাণীর পশম, চুল বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে অ্যানথ্রাক্স স্পোর মানুষের ত্বকের অতিসূক্ষ্ণ ক্ষত দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় সাধারণতঃ ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ত্বকের ক্ষত তৈরি হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষত
দুই হাতে মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ঘাড় এবং মাথাও আক্রান্ত হতে পারে। ত্বকে ধীরে ধীরে ঘা তৈরি হয় যা ২-৩ সেমি আয়তনের হয়ে থাকে এবং ঘা এর চারদিকের ত্বক একটু উঁচু হয়ে থাকে। ক্ষতে চুলকানি থাকে তবে ব্যথা থাকে না। দ্রুত চিকিত্সা না নিলে , সংক্রমণ লসিকা গ্রন্থি বা রক্ত (সেপটিসেমিয়া) ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২। শ্বসনতন্ত্রের (Pulmonary) অ্যানথ্রাক্সঃ অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর স্পোর যদি শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরুর দিকে হাল্কা জ্বর, খুশখুশে কাশি এবং বুকে অল্প ব্যথা হয়। পরবর্তীতে তীব্র জ্বর, শ্বাসকষ্ট, শরীর নীল হয়ে যাওয়া, শরীর বেশী ঘেমে যাওয়া, কাশির সাথে রক্ত বের হওয়া, বুকে ব্যাথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। সঠিক সময়ে চিকিত্সা না নিলে , মৃত্যুর হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে, পালমোনারি অ্যানথ্রাক্স চিকিত্সা করলেও মারাত্মক রুপ ধারণ করতে পারে।
৩। মুখবিবরীয় গলার (oropharyngeal) অ্যানথ্রাক্সঃ অ্যানথ্রাক্স স্পোর খেলে এ অবস্থা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে মুখের তালু বা মুখবিবরে(pharynx) ক্ষত দেখা দেয়। এর ফলে গলাব্যথা, খাবার গিলতে অসুবিধা হয়।
৪। পরিপাকতন্ত্রের (Gastrointestinal) অ্যানথ্রাক্সঃ উন্নত দেশগুলোতে খুব বিরল। এটা ঘটে যখন একজন ব্যক্তি, একটি সংক্রামিত প্রাণীর মাংস খায়। প্রাথমিক লক্ষণ গুলো হলো- বমি বমি ভাব, বমি, রক্ত বমি, ডায়রিয়া এবং উচ্চ তাপমাত্রা। সংক্রমণ রক্ত (সেপটিসেমিয়া) ছড়িয়ে পড়েলে, মৃত্যুর হার ২৫ থেকে ৬০ শতাংশ ও হতে পারে।
৫। সেপটিসেমিক (septicemic) অ্যানথ্রাক্সঃ এটি অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর চড়ম-মাত্রার ইনফেকশনের জন্য হয়। ত্বকের, শ্বসনতন্ত্রের বা পরিপাকতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স এর জটিলতা থেকেও এটি হতে পারে। রক্তের মাধ্যমে জীবাণু সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, বংশবৃদ্ধি করে এবং টক্সিন তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে রক্তক্ষরণ ঘটায়। এই রক্ত গাঢ় কালো রঙের। আক্রান্ত গবাদিপ্রাণীর ক্ষেত্রে প্রাণীর মৃত্যুর ঠিক আগে অথবা মৃত্যুর পরপরই শরীরের বিভিন্ন ছিদ্র থেকে কালো রক্ত বের হয়ে আসে।
৬। অ্যানথ্রাক্স মেনিনজাইটিস (anthrax meningitis): উপরের যে কোন ধরণের রোগ থেকে এটা হতে পারে। এক্ষেত্রে জীবাণু প্রথমে রক্ত এবং তারপর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে(CNS) প্রবেশ করে। এই অবস্থা তৈরী হলে প্রাণীর মৃত্য প্রায় নিশ্চিত।
অ্যানথ্রাক্স নির্ণয়ঃ
রোগের লক্ষণ দেখে সহজেই এ রোগ নির্ণয় করা যায়। তাছাড়া রক্ত পরীক্ষা করলে ছোট ছোট দণ্ডের মতো ব্যাক্টেরিয়া দেখতে পাওয়া যায়। এ রোগে মৃত প্রাণীর ময়নাতদন্ত করা হয় না। তবে ভুলক্রমে বা জরুরী অবস্থায় (আমাদের দেশে মৃতপ্রায় প্রাণীকে জবাই করার প্রবণতা প্রচুর!!) ময়নাতদন্ত করলে দেখা যায় প্লীহা বড় হয়ে গেছে এবং মাংশপেশীতে রক্তের দাগও পাওয়া যাবে। অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত গরু চেনাও যেমন খুব সহজ তেমনি অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত গরু যবাইয়ের পর তার গোস্ত চেনাও আদৌ কষ্টকর নয়। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু যবাই করার ঘণ্টাখানেক পরই গোস্তের বর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। উৎকট গন্ধ বের হয়। আক্রান্ত গোস্তে চাপ দিলে বুদবুদ বের হয় ও দেবে যায়। এছাড়া গোস্তের দোকানে ঝোলানো কলিজা থেকে যদি আলকাতরার মতো কালো রক্ত ঝরে তাহলে বুঝতে হবে যবাই করা পশুটি অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত। সুতরাং অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক বলে কোন কিছু প্রচারণার প্রয়োজন পড়ে না।
চিকিৎসাঃ
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণীর সাধারণত চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ পাওয়া যায় না, তার আগেই আক্রান্ত প্রাণী মারা যায়। যদি কখনো আক্রান্ত প্রাণী পাওয়া যায় তবে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবয়োটিক যেমন- Quinolones, Ciprofloxacin, Doxycycline, Erythromycin, Vancomycin, Penicillin ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এর সাথে এন্টিহিস্টামিনিক জাতীয় ঔষধ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
মানুষের ক্ষেত্রে এ রোগের চিকিৎসা অনেকটা সহজলভ্য বলে তেমন একটা জীবনহানি ঘটে না। সময়মতো ও সঠিকভাবে চিকিৎসা নিলে অ্যানথ্রাক্স রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও আটলান্টার রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (CDC) গাইড লাইন অনুযায়ী – অ্যানথ্রাক্স এন্টি-টক্সিন অথবা সিপ্রোফ্লোক্সাসিন , ডক্সিসাইক্লিন বা পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসায় রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।
প্রতিরোধঃ
অ্যানথ্রাক্সের প্রতিরোধ নির্ভর করে গবাদিপশুর রোগ নিয়ন্ত্রণের ওপর। ভ্যাকসিন দেয়াই এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। গবাদিপশুর জন্য অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাকসিন আছে। এটি খুব স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়। সরকারি প্রাণিসম্পদ হাসপাতালগুলোতে এর ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। ভ্যাকসিন দেওয়ার মাধ্যমে গবাদিপশুকে এ রোগের হাত থেকে রক্ষা করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব, তেমনি মানব আক্রান্তের হারও কমানো যায়। লাইভ এবং কিলড উভয় ধরনের ভ্যাকসিনই পাওয়া যায়। চামড়ার নিচে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১০-১৫ দিনের মধ্যেই গরুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আক্রান্ত গরুতে আগে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়ে থাকলে নতুন করে ভ্যাকসিন দেয়ার প্রয়োজন হয় না। ভ্যাকসিন ৬ মাস পর পর দিতে হয়। ভ্যাকসিন দেওয়ার ৪-৫ সপ্তাহ পর প্রাণীর মাংস খাওয়ার জন্য নিরাপদ বলে গণ্য করা যায়।
মানুষের জন্য অ্যানথ্রাক্স এর প্রতিষেধক (vaccine) ১৯৭০ সালে আবিষ্কৃত হলেও তা এখনো আমাদের দেশে দুষ্প্রাপ্য। তাই গবাদিপ্রাণীকে টীকা দেয়ার মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ করা যেতে পারে। আক্রান্ত প্রাণী মারা গেলে মাটিতে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত অসুস্থ গবাদিপ্রাণী জবাই করা যাবে না। মৃত গবাদিপ্রাণী এমনভাবে পুঁতে ফেলতে হবে, যাতে শেয়াল বা অন্য কোন প্রাণী মাটি খুঁড়ে নাগাল না পায়। কোন এলাকায় অ্যানথ্রাক্স দেখা দিলে সে এলাকার গবাদিপ্রাণী মাঠে না চরানোই ভালো। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে এলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক অথবা ডক্সিসাইক্লিন ৬০ দিন সেবন করতে হবে।
অ্যানথ্রাক্স নির্মূলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাসমুহঃ
• আক্রান্ত এলাকা থেকে অসুস্থ প্রাণী অন্যত্র আনা-নেওয়া বন্ধ করতে হবে
• যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া প্রাণী জবাই করা হলে বন্ধ করতে হবে
• অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণী কিছুতেই জবাই করা যাবে না
• খালি হাতে অসুস্থ ও মৃত গবাদি প্রাণী ধরা যাবে না, হাতে গ্লাভস বা পলিথিনের আবরণ ব্যবহার করতে হবে
• মৃত প্রাণীটি মাটিতে কমপক্ষে ছয় ফুট গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে
• পুতে ফেলার পর, উক্ত স্থানে চুন বা ব্লিচিং পাওডার ছিটিয়ে দিতে হবে
• প্রাণী খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের আগে আমদানিকৃত Bonemeal বা পশম, চুল, চামড়া এবং অন্যান্য সংক্রমিত পণ্য ইথিলিন অক্সাইড গ্যাস বা গামারশ্নি বিকিরণ দ্বারা জীবাণুমুক্ত করতে হবে
• অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণীর চিকিৎসায় ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তবে আক্রান্ত হওয়ার আগে ভ্যাকসিন দেওয়া হলে প্রাণিটি নিরাপদ থাকবে।
• এলাকায় সকল সুস্থ গবাদিপ্রাণীকে অ্যানথ্রাক্স (তড়কা) রোগের ভ্যাকসিন (রিং ভ্যাকসিনেশন) দিতে হবে
এ বিষয়ে স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে ।
বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাবঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব হরহামেশা দেখা গেলেও বাংলাদেশে এই রোগটি নিয়ে এত দিন কোন উচ্চ-বাচ্চ্য ছিলনা বললেই চলে। কিন্তু পরবর্তীতে গরু, ছাগল ও ভেড়ার পাশাপাশি আক্রান্ত হয় মানুষও। বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স রোগ নিয়ে প্রথম রিপোর্ট হয় ১৯৮০-১৯৮৪ সালে যেখানে গবাদিপ্রাণী ও মানুষ উভয়ই আক্রান্ত হয়েছিল তবে আতংকের সৃষ্টি হয় ২০০৯ সালে, সিরাজগঞ্জে। সিরাজগঞ্জ ছাড়াও পাবনা এবং টাঙ্গাইলে, বগুড়া, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরও এই রোগের বিস্তৃতি রয়েছে। আইসিডিডিআরবি এর এক তথ্য অনুযায়ী আগস্ট ২০০৯ থেকে অক্টোবর, ২০১০ পর্যন্ত পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এর চারটি উপজেলার ১৪টি গ্রামে এই রোগে প্রায় ১৪০ টি প্রাণী এবং ২৭৩ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রতি বছরই কমবেশি এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি (মে, ২০১৬) সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর ও কামারখন্দ উপজেলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে অ্যানথ্রাক্স রোগ। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে এখন পর্যন্ত কামারখন্দ উপজেলার জামতৈলে ২৯ জন, উল্লাপাড়ায় ৪৩ জন এবং শাহজাদপুরে ১৮ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার সড়াতৈল গ্রামে আক্রান্ত রোগীদের মতে এখন পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে মোট ১৮টি গরু মারা গেছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এর তথ্যমতে, সিরাজগঞ্জে ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৩৩ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রনের জন্য শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিন্তু আসল উৎস প্রাণী থেকে নির্মুলের জন্য তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তাই কিছুদিন পর-পরই এই সমস্যা বারবার দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং ভেটেরিনারিয়ান’দের যৌথ উদ্যোগ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই অ্যানথ্রাক্স নির্মুল করা সম্ভব। অ্যানথ্রাক্স নয়, অ্যানথ্রাক্স নামক আতংক জনমনে সংক্রামিত হলে গবাদিপ্রাণী পালনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরীই, রোগ নির্মুলে মুখ্য ভুমিকা পালন করতে পারে।
তথ্যসুত্রঃ
• প্রফেসর ডঃ মোঃ এম এ সামাদ, ২০০১; পশু পালন ও চিকিৎসাবিদ্যা, দ্বিতীয় সংস্করণ; লেপ প্রকাশনা। তড়কা রোগ (Anthrax); পৃষ্ঠা ৫৯৩-৫৯৫।
• ড. মোঃ জালাল উদ্দিন সরদার, ২০১২ গৃহপালিত পশু-পাখির চিকিৎসা ওগরু মোটাতাজাকরণের আধুনিক পদ্ধতি, চতুর্থ সংস্করণ, নূর পাবলিকেশন্স। তড়কা (Anthrax) পৃষ্ঠা ৫৩-৫৫।
• https://news.google.com.bd/news/story?cf=all&hl=bn&ned=bn_bd&cf=all&ncl=dG42KIQRaPGWpEMonwEy43VpfyOHM&topic=h&scoring=n
• http://www.oie.int/doc/ged/D14091.PDF
• http://aces.nmsu.edu/pubs/_b/B120.pdf
• http://www.nytimes.com/health/guides/disease/anthrax/overview.html?utm_source=affiliate&utm_medium=ls&utm_campaign=PPkX79/c*b0&utm_content=357585&utm_term=177&siteID=PPkX79_c.b0-wuJKVLcNKiGfdiyCnhQMHA
• http://www.infectionecologyandepidemiology.net/index.php/iee/article/view/21356
সম্পাদনায়,
ডাঃ মোঃ কামরুল হাসান (মিলন)
এম. এস. ইন মেডিসিন
মেডিসিন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ, ২২০২
এবং
ডাঃ মাহমুদা আক্তার
এম. এস. ইন মেডিসিন
মেডিসিন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ, ২২০২
No comments:
Post a Comment