Saturday, May 21, 2016

অ্যানথ্রাক্স - আতংক নয় প্রয়োজন সচেতনতার



বেশ কিছু বছর ধরেই এশিয়ায় প্রাণিবাহিত রোগের প্রকপ বৃদ্ধি পেয়েছে - এভিয়ান ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, জলাতংক, নিপাহ ভাইরাস’র পর সম্প্রতি দেখা দিয়েছে অ্যানথ্রাক্স। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। যেসব রোগ প্রাণি-পাখি হতে বিভিন্ন মাধ্যমে মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করে সেসব রোগকে বলা হয় জুনোটিক রোগ (Zoonotic Disease)। অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা বা  ব্ল্যাক ব্লাড তেমনই একটি প্রাণিবাহিত জুনোটিক রোগ যা একাধারে গবাদিপ্রাণী ও মানুষে রোগ সৃষ্টি করে জনজীবনে আতংক তৈরী করে চলেছে।

অ্যানথ্রাক্স কি ?

অ্যানথ্র্যাক্স’  একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ কয়লা। কারণ অ্যানথ্রাক্স রোগীর চামড়ায় যে ক্ষত হয় তা কালো ছাইয়ের মতো দেখায়। যে জীবাণু দ্বারা রোগটি হয় তার নাম ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস(Bacillus anthracis)। এটি একধরণের গ্রাম পজিটিভ রড আকৃতির ব্যাক্টেরিয়া। জীবাণুটি বিভিন্ন রকমের টক্সিন তৈরি করতে পারে যাদের এক্সোটক্সিন বলা হয়। এই টক্সিনগুলোই বিভিন্ন রকমের রোগ এবং রোগজনিত জটিলতার জন্য দায়ী। আর, রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গরু মারা যায়। অনেক সময় লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পরপরই গরু মারা যেতে পারে ফলে চিকিৎসার কোনো সুযোগই পাওয়া যায় না। এমনই মারাত্মক ব্যাধি অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ এবং পাবনার কয়েকটি থানায় এ রোগটি দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে অনেক গরু, মারাও গেছে বেশ কিছু। সিরাজগঞ্জ বা পাবনা’তেই যে এ রোগ প্রথম দেখা দিয়েছে তা নয়। অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগের ইতিহাস অনেক পুরনো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯১ সালেও মিসরে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল বলে জানা যায়। শুধু মিসর নয়, গ্রিস, রোম এমনকি ভারতবর্ষেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে এ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকায় ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার রেকর্ড রয়েছে। এমনকি মাত্র তিন দশক আগে ১৯৭৮-৮০ সালে জিম্বাবুয়েতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে শুধু প্রাণী নয়, প্রায় দশ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়, মারা যায় প্রায় ১৫১ জন।  প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ২০০০ মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে থাকে যার মাঝে গড়ে ২ জন থাকে আমেরিকার।  


অ্যানথ্রাক্স এর বিস্তৃতিঃ
আমেরিকা (উত্তর), ইউরোপে অ্যানথ্রাক্স এর প্রকোপ অনেক কম। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য-সহ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল,আফ্রিকা এবং ল্যাতিন আমেরিকায় এর প্রাদুর্ভাব লক্ষ্যণীয়। জীবাণুযুদ্ধে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ব্যবহৃত হয়; চিঠি বা প্যাকেটের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স স্পোর ছড়িয়ে দেয়া হয় অথবা বড় পরিসরে ছড়ানোর জন্য অ্যানথ্রাক্স জীবাণু এরোসল আকারে স্প্রে করা হয়। মূলত গরুতে এ রোগ বেশি প্রকাশ পায়, তবে ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, মহিষ, জেব্রা, জিরাফ, হরিণ, শূকর, হাতি এবং বানরও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মাংসাশী প্রানী যেমন কুকুরে আক্রান্ত মাংস সেবনের মাধ্যমেই অ্যানথ্রাক্স হয়ে থাকে। সাধারণত, পাখিদের এ রোগ হয় না। প্রাণী থেকে মানুষে এ রোগ ছড়ায় বলেই ভয়ের কারণটা একটু বেশি।  মানুষের ত্বকের মাধ্যমে সাধারণতঃ অ্যানথ্রাক্স জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু ত্বকে যদি অতিক্ষুদ্র ক্ষতও থাকে তবে জীবাণু ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। যে কোন বয়সের, শ্রেণীর এবং লিঙ্গের  মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হতে পারে। অ্যানথ্রাক্স বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই গবাদিপ্রাণীর লালন-পালন, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং প্রাণীজাত দ্রব্যাদির শিল্প (যেমন-ট্যানারী, মিট-মিল/ বোন-মিল প্রস্তুতকারক প্রভৃতি) সম্পর্কিত মানুষের বেশী হয়, এজন্য তরুণ এবং মধ্যবয়সী কর্মক্ষম মানুষের এ রোগ বেশী হয়। আবার অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশুর মাংস কাটাকাটি বা খাওয়ার  মাধ্যমে যে কারও এ রোগ হতে পারে, কারণ স্বাভাবিক রান্নার তাপে অ্যানথ্রাক্স স্পোর নষ্ট হয় না।

অ্যানথ্রাক্স যেভাবে ছড়ায়ঃ 

অ্যানথ্রাক্স মূলত তৃণভোজী পশুর রোগ। ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস (B. anthracis) ব্যাকটেরিয়াটি স্পোর বা শক্ত আবরণী তৈরি করে অনেক বছর (প্রায় ৬০ বছর) পর্যন্ত মাটিতে বেঁচে থাকতে পারে। মূলত, ঘাস খাওয়ার সময় গবাদিপ্রাণী এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত গবাদিপ্রাণীর সংস্পর্শে এলেই কেবল মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। অসুস্থ গবাদিপ্রাণীর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদির সংস্পর্শের মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণি এবং মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এটি মূলত চারটি উপায়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে যেমন- ত্বক (ক্ষত), শ্বসনপ্রণালী,  খাদ্যনালী (ক্ষুদ্রান্ত্র) ও ইনজেকশন এর মাধ্যমে। 

অ্যানথ্রাক্স কোথাও একবার এ রোগ দেখা দিলে তা পরবর্তী সময়ে আবারো দেখা দিতে পারে। ট্যানারি বর্জ্যরে সঠিক ও সুষ্ঠু নিষ্কাশন এ জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। অ্যানথ্রাক্সে মৃত গরুর চামড়া ট্যানারিতে গেলে তা থেকে জীবাণু চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভয়াবহ অবস্খার সৃষ্টি হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। 


প্রাণীতে অ্যানথ্রাক্সের লক্ষনসমুহঃ
B. anthracis ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট হল, এরা প্রতিকুল পরিবেশেও Spore হিসেবে অনেকদিন থাকতে পারে এবং অনূকুল পরিবেশে পরবর্তীকালে তারা রোগের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়। পশু অথবা মানুষের শরীরে জীবাণু প্রবেশের পর রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে ১-২ সপ্তাহের মত সময় লাগে। তবে, বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ফুসফুস সংক্রমিত হলে অতি অল্প সময়ে তার লক্ষন পরিলক্ষিত হতে পারে।
 অ্যানথ্রাক্স এর উল্লেখযোগ্য লক্ষণসমুহ হলো-


অত্যাধিক জ্বর হয় (১০৩০-১০৭০ ফাঃ)

শ্বাসকষ্ট এবং দাঁত কটকট করে
শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠে
প্রাণীকে কিছুটা উত্তেজিত দেখায়
আক্রান্ত প্রাণী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে
প্রাণী নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ে
লেজ দিয়া মশা মাছি তাড়াবে না
খিঁচুনি হয় ও অবশেষে প্রাণী মারা যায়
অনেক সময় লক্ষণসমূহ প্রকাশের আগেই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে
মৃত প্রাণীর পেট দ্রুত ফেঁপে যায় 
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বা পরে প্রাণীর নাক, মুখ, কান, মলদ্বার ও যোনিপথ দিয়ে আলকাতরার মত কাল রঙয়ের রক্ত বের হয়
এই রোগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – প্রাণী মারা যাওয়ার পর কখনো জমাট বাঁধে না।

মানুষে লক্ষণসমূহঃ
মানুষে এই ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর সুপ্তিকাল বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড দুই থেকে সাত দিন। এটি প্রাণী  থেকে মানুষে ছড়ায়; কিন্তু মানুষ থেকে মানুষে সরাসরি ছড়ায় না এর মানে হলো আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে একজন মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এলে অন্য আরেকজন মানুষ আক্রান্ত হবে না।
 
অ্যানথ্রাক্স জীবাণু মানুষের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্ত অঙ্গ অনুযায়ী রোগের ধরনও বিভিন্ন রকম হয়। যেমনঃ

১। ত্বকের (Cutaneous) অ্যানথ্রাক্সঃ শরীরের অন্যান্য অংশের চেয়ে ত্বক-ই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়, প্রায় ৯৫ শতাংশ। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত প্রাণী অথবা অ্যানথ্রাক্স স্পোর দ্বারা দূষিত প্রাণীর পশম, চুল বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে অ্যানথ্রাক্স স্পোর মানুষের ত্বকের অতিসূক্ষ্ণ ক্ষত দিয়েও প্রবেশ করতে পারে। এ অবস্থায় সাধারণতঃ ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ত্বকের ক্ষত তৈরি হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষত 

দুই হাতে মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ঘাড় এবং মাথাও আক্রান্ত হতে পারে। ত্বকে ধীরে ধীরে ঘা তৈরি হয় যা ২-৩ সেমি আয়তনের হয়ে থাকে এবং ঘা এর চারদিকের ত্বক একটু উঁচু হয়ে থাকে। ক্ষতে চুলকানি থাকে তবে ব্যথা থাকে না। দ্রুত চিকিত্সা না নিলে , সংক্রমণ লসিকা গ্রন্থি বা রক্ত (সেপটিসেমিয়া) ছড়িয়ে পড়তে পারে। 
২। শ্বসনতন্ত্রের (Pulmonary) অ্যানথ্রাক্সঃ অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর স্পোর যদি শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরুর দিকে হাল্কা জ্বর, খুশখুশে কাশি এবং বুকে অল্প ব্যথা হয়। পরবর্তীতে তীব্র জ্বর, শ্বাসকষ্ট, শরীর নীল হয়ে যাওয়া, শরীর বেশী ঘেমে যাওয়া, কাশির সাথে রক্ত বের হওয়া, বুকে ব্যাথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। সঠিক সময়ে চিকিত্সা না নিলে , মৃত্যুর হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে, পালমোনারি অ্যানথ্রাক্স চিকিত্সা করলেও মারাত্মক রুপ ধারণ করতে পারে।

৩। মুখবিবরীয় গলার (oropharyngeal) অ্যানথ্রাক্সঃ অ্যানথ্রাক্স স্পোর খেলে এ অবস্থা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে মুখের তালু বা মুখবিবরে(pharynx) ক্ষত দেখা দেয়। এর ফলে গলাব্যথা, খাবার গিলতে অসুবিধা হয়। 

৪। পরিপাকতন্ত্রের (Gastrointestinal) অ্যানথ্রাক্সঃ উন্নত দেশগুলোতে খুব বিরল। এটা ঘটে যখন একজন ব্যক্তি, একটি সংক্রামিত প্রাণীর মাংস খায়। প্রাথমিক লক্ষণ গুলো হলো- বমি বমি ভাব, বমি, রক্ত বমি, ডায়রিয়া এবং উচ্চ তাপমাত্রা। সংক্রমণ রক্ত (সেপটিসেমিয়া) ছড়িয়ে পড়েলে, মৃত্যুর হার ২৫ থেকে ৬০ শতাংশ ও হতে পারে।
৫। সেপটিসেমিক (septicemic) অ্যানথ্রাক্সঃ এটি অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর চড়ম-মাত্রার ইনফেকশনের জন্য হয়। ত্বকের, শ্বসনতন্ত্রের বা পরিপাকতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স এর জটিলতা থেকেও এটি হতে পারে। রক্তের মাধ্যমে জীবাণু সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, বংশবৃদ্ধি করে এবং টক্সিন তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে রক্তক্ষরণ ঘটায়। এই রক্ত গাঢ় কালো রঙের। আক্রান্ত গবাদিপ্রাণীর ক্ষেত্রে প্রাণীর মৃত্যুর ঠিক আগে অথবা মৃত্যুর পরপরই শরীরের বিভিন্ন ছিদ্র থেকে কালো রক্ত বের হয়ে আসে। 

৬। অ্যানথ্রাক্স মেনিনজাইটিস (anthrax meningitis): উপরের যে কোন ধরণের রোগ থেকে এটা হতে পারে। এক্ষেত্রে জীবাণু প্রথমে রক্ত এবং তারপর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে(CNS) প্রবেশ করে। এই অবস্থা তৈরী হলে প্রাণীর মৃত্য প্রায় নিশ্চিত।


অ্যানথ্রাক্স নির্ণয়ঃ
রোগের লক্ষণ দেখে সহজেই এ রোগ নির্ণয় করা যায়। তাছাড়া রক্ত পরীক্ষা করলে ছোট ছোট দণ্ডের মতো ব্যাক্টেরিয়া দেখতে পাওয়া যায়। এ রোগে মৃত প্রাণীর ময়নাতদন্ত করা হয় না। তবে ভুলক্রমে বা জরুরী অবস্থায় (আমাদের দেশে মৃতপ্রায় প্রাণীকে জবাই করার প্রবণতা প্রচুর!!) ময়নাতদন্ত করলে দেখা যায় প্লীহা বড় হয়ে গেছে এবং মাংশপেশীতে  রক্তের দাগও পাওয়া যাবে। অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত গরু চেনাও যেমন খুব সহজ তেমনি অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত গরু যবাইয়ের পর তার গোস্ত চেনাও আদৌ কষ্টকর নয়। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু যবাই করার ঘণ্টাখানেক পরই গোস্তের বর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। উৎকট গন্ধ বের হয়। আক্রান্ত গোস্তে চাপ দিলে বুদবুদ বের হয় ও দেবে যায়। এছাড়া গোস্তের দোকানে ঝোলানো কলিজা থেকে যদি আলকাতরার মতো কালো রক্ত ঝরে তাহলে বুঝতে হবে যবাই করা পশুটি অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত। সুতরাং অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক বলে কোন কিছু প্রচারণার প্রয়োজন পড়ে না। 

চিকিৎসাঃ

অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণীর সাধারণত চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ পাওয়া যায় না, তার আগেই আক্রান্ত প্রাণী মারা যায়। যদি কখনো আক্রান্ত প্রাণী পাওয়া যায় তবে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবয়োটিক যেমন- Quinolones, Ciprofloxacin, Doxycycline, Erythromycin, Vancomycin, Penicillin ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এর সাথে এন্টিহিস্টামিনিক জাতীয় ঔষধ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

মানুষের ক্ষেত্রে এ রোগের চিকিৎসা অনেকটা সহজলভ্য বলে তেমন একটা জীবনহানি ঘটে না। সময়মতো ও সঠিকভাবে চিকিৎসা নিলে অ্যানথ্রাক্স রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও আটলান্টার রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (CDC) গাইড লাইন অনুযায়ী – অ্যানথ্রাক্স এন্টি-টক্সিন অথবা সিপ্রোফ্লোক্সাসিন , ডক্সিসাইক্লিন বা পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসায় রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।  

প্রতিরোধঃ
অ্যানথ্রাক্সের প্রতিরোধ নির্ভর করে গবাদিপশুর রোগ নিয়ন্ত্রণের ওপর। ভ্যাকসিন দেয়াই এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। গবাদিপশুর জন্য অ্যানথ্রাক্সের ভ্যাকসিন আছে। এটি খুব স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়। সরকারি প্রাণিসম্পদ হাসপাতালগুলোতে এর ভ্যাকসিন  দেওয়া যাবে। ভ্যাকসিন  দেওয়ার মাধ্যমে গবাদিপশুকে এ রোগের হাত থেকে রক্ষা করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব, তেমনি মানব আক্রান্তের হারও কমানো যায়। লাইভ এবং কিলড উভয় ধরনের ভ্যাকসিনই পাওয়া যায়। চামড়ার নিচে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১০-১৫ দিনের মধ্যেই গরুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আক্রান্ত গরুতে আগে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়ে থাকলে নতুন করে ভ্যাকসিন দেয়ার প্রয়োজন হয় না। ভ্যাকসিন ৬ মাস পর পর দিতে হয়। ভ্যাকসিন দেওয়ার ৪-৫ সপ্তাহ  পর প্রাণীর মাংস খাওয়ার জন্য নিরাপদ বলে গণ্য করা যায়।
মানুষের জন্য অ্যানথ্রাক্স এর প্রতিষেধক (vaccine) ১৯৭০ সালে আবিষ্কৃত হলেও তা এখনো আমাদের দেশে দুষ্প্রাপ্য। তাই গবাদিপ্রাণীকে টীকা দেয়ার মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ করা যেতে পারে। আক্রান্ত প্রাণী মারা গেলে মাটিতে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত অসুস্থ গবাদিপ্রাণী জবাই করা যাবে না। মৃত গবাদিপ্রাণী এমনভাবে পুঁতে ফেলতে হবে, যাতে শেয়াল বা অন্য কোন প্রাণী মাটি খুঁড়ে নাগাল না পায়। কোন এলাকায় অ্যানথ্রাক্স দেখা দিলে সে এলাকার গবাদিপ্রাণী মাঠে না চরানোই ভালো। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে এলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক অথবা ডক্সিসাইক্লিন ৬০ দিন সেবন করতে হবে। 


অ্যানথ্রাক্স নির্মূলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাসমুহঃ
আক্রান্ত এলাকা থেকে অসুস্থ প্রাণী অন্যত্র আনা-নেওয়া বন্ধ করতে হবে
যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া প্রাণী জবাই করা হলে বন্ধ করতে হবে
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণী কিছুতেই জবাই করা যাবে না
খালি হাতে অসুস্থ ও মৃত গবাদি প্রাণী ধরা যাবে না, হাতে গ্লাভস বা পলিথিনের আবরণ ব্যবহার করতে হবে
মৃত প্রাণীটি মাটিতে কমপক্ষে ছয় ফুট গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে
পুতে ফেলার পর, উক্ত স্থানে চুন বা ব্লিচিং পাওডার ছিটিয়ে দিতে হবে
প্রাণী খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের আগে আমদানিকৃত Bonemeal বা পশম, চুল, চামড়া এবং অন্যান্য সংক্রমিত পণ্য ইথিলিন অক্সাইড গ্যাস বা গামারশ্নি বিকিরণ দ্বারা জীবাণুমুক্ত করতে হবে
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণীর চিকিৎসায় ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তবে আক্রান্ত হওয়ার আগে ভ্যাকসিন দেওয়া হলে প্রাণিটি নিরাপদ থাকবে। 
এলাকায় সকল সুস্থ গবাদিপ্রাণীকে অ্যানথ্রাক্স (তড়কা) রোগের ভ্যাকসিন (রিং ভ্যাকসিনেশন) দিতে হবে
এ বিষয়ে স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে ।

বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাবঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব হরহামেশা দেখা গেলেও বাংলাদেশে এই রোগটি নিয়ে এত দিন কোন উচ্চ-বাচ্চ্য ছিলনা বললেই চলে। কিন্তু পরবর্তীতে গরু, ছাগল ও ভেড়ার পাশাপাশি আক্রান্ত হয় মানুষও। বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স রোগ নিয়ে প্রথম রিপোর্ট হয় ১৯৮০-১৯৮৪ সালে যেখানে গবাদিপ্রাণী ও মানুষ উভয়ই আক্রান্ত হয়েছিল তবে আতংকের সৃষ্টি হয় ২০০৯ সালে, সিরাজগঞ্জে। সিরাজগঞ্জ ছাড়াও পাবনা এবং টাঙ্গাইলে, বগুড়া, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরও এই রোগের বিস্তৃতি রয়েছে। আইসিডিডিআরবি এর এক তথ্য অনুযায়ী আগস্ট ২০০৯ থেকে অক্টোবর, ২০১০ পর্যন্ত পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এর চারটি উপজেলার ১৪টি গ্রামে এই রোগে প্রায় ১৪০ টি প্রাণী এবং ২৭৩ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রতি বছরই কমবেশি এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি (মে, ২০১৬) সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর ও কামারখন্দ উপজেলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে অ্যানথ্রাক্স রোগ। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে এখন পর্যন্ত কামারখন্দ উপজেলার জামতৈলে ২৯ জন, উল্লাপাড়ায় ৪৩ জন এবং শাহজাদপুরে ১৮ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার সড়াতৈল গ্রামে আক্রান্ত রোগীদের মতে এখন পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে মোট ১৮টি গরু মারা গেছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এর তথ্যমতে,  সিরাজগঞ্জে ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৩৩ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রনের জন্য শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিন্তু আসল উৎস প্রাণী থেকে নির্মুলের জন্য তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তাই কিছুদিন পর-পরই এই সমস্যা বারবার দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং ভেটেরিনারিয়ান’দের যৌথ উদ্যোগ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই অ্যানথ্রাক্স নির্মুল করা সম্ভব। অ্যানথ্রাক্স নয়, অ্যানথ্রাক্স নামক আতংক জনমনে সংক্রামিত হলে গবাদিপ্রাণী পালনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরীই, রোগ নির্মুলে মুখ্য ভুমিকা পালন করতে পারে।   



তথ্যসুত্রঃ
প্রফেসর ডঃ মোঃ এম এ সামাদ, ২০০১; পশু পালন ও চিকিৎসাবিদ্যা,  দ্বিতীয় সংস্করণ; লেপ প্রকাশনা। তড়কা রোগ (Anthrax); পৃষ্ঠা ৫৯৩-৫৯৫।
ড. মোঃ জালাল উদ্দিন সরদার, ২০১২ গৃহপালিত পশু-পাখির চিকিৎসা ওগরু মোটাতাজাকরণের আধুনিক পদ্ধতি, চতুর্থ সংস্করণ, নূর পাবলিকেশন্স। তড়কা (Anthrax) পৃষ্ঠা ৫৩-৫৫। 
https://news.google.com.bd/news/story?cf=all&hl=bn&ned=bn_bd&cf=all&ncl=dG42KIQRaPGWpEMonwEy43VpfyOHM&topic=h&scoring=n
http://www.oie.int/doc/ged/D14091.PDF
http://aces.nmsu.edu/pubs/_b/B120.pdf
http://www.nytimes.com/health/guides/disease/anthrax/overview.html?utm_source=affiliate&utm_medium=ls&utm_campaign=PPkX79/c*b0&utm_content=357585&utm_term=177&siteID=PPkX79_c.b0-wuJKVLcNKiGfdiyCnhQMHA
http://www.infectionecologyandepidemiology.net/index.php/iee/article/view/21356

সম্পাদনায়, 
ডাঃ মোঃ কামরুল হাসান (মিলন)   
এম. এস. ইন মেডিসিন
মেডিসিন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ, ২২০২
এবং
ডাঃ মাহমুদা আক্তার
এম. এস. ইন মেডিসিন
মেডিসিন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ, ২২০২


Friday, May 20, 2016

বাংলাদেশে ভেড়ার ব্রুসেলোসিস এবং আমাদের করণীয় @ Brucellosis in Sheep in BD



দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। জাতিসঙ্ঘের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী এটি একটি স্বল্পোন্নত দেশ (Least Developed Country)। শিল্প ও সেবা খাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ সত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অদ্যাবধি কৃষিনির্ভর কারণ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষিজীবী। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে পারিবারিকভাবে, বিশেষ করে খামারে গবাদি প্রাণি যেমন- গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া এবং হাঁস-মুরগি প্রতিপালন যেকোনো দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এসব প্রাণি, কৃষি কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কাজে চালিকা শক্তি, চামড়া ও সার এবং জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের জন্য মাংস ও দুধের সরবরাহের প্রধান উৎস। 


বাংলাদেশের শতকরা ৮৩.৯ ভাগ পরিবার প্রাণি-পাখি প্রতিপালন করছে। তবে শুধু গরু-মহিষ প্রতিপালন করছে শতকরা ৪৫.৯ ভাগ পরিবার। এ ছাড়া ছাগল-ভেড়া প্রতিপালন করছে শতকরা ৩১.৪ ভাগ এবং হাঁস-মুরগি শতকরা ৭৬.৩ ভাগ পরিবার। প্রাণিসম্পদ, ভূমিহীন মানুষের জীবিকার একটা বড় অবলম্বন। বর্তমানে এ দেশে ২৫.৭ মিলিয়ন গরু, ০.৮৩ মিলিয়ন মহিষ, ১৪.৮ মিলিয়ন ছাগল, ১.৯ মিলিয়ন ভেড়া, ১১৮.৭ মিলিয়ন মুরগি এবং ৩৪.১ মিলিয়ন হাঁস রয়েছে। 
প্রাণিসম্পদের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে জড়িত রয়েছে গবাদি প্রাণির স্বাস্থ্য ও কল্যাণ, উৎপাদন উপাত্তগুলির মান এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসা-উদ্যোগ প্রসারের কার্যকর ব্যবস্থা। পরিসংখ্যান অনুসারে মোট জাতীয় উৎপাদের (জিডিপি’র) প্রায় ২.৯% যোগায় প্রাণিসম্পদ খাত এবং এটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫%। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা বা পরজীবী প্রাণীর সংক্রমণ অথবা বিপাক ক্রিয়ায় ভারসাম্যের ত্রুটির কারণে গবাদি প্রাণির স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। তদুপরি, আপাতদৃষ্টিতে স্বাস্থ্যবান একটি প্রাণির ভালো প্রজনন স্বাস্থ্য থাকবে এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই। প্রজননক্ষমতা লোপ, গর্ভধারণে ব্যর্থতা,  ভ্রূণাবস্থায় মৃত্যু ও গর্ভপাত এবং স্ত্রী প্রাণির অন্যান্য রোগের সঙ্গে প্রায়শ দুর্বল প্রজনন কর্মকান্ড সম্পর্কিত থাকে। প্রজনন ও স্বাস্থ্যে ব্যাঘাত ঘটায়, এরকম একটি রোগের নাম ব্রুসেলোসিস (Brucellosis)। এটি মূলত একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ যা Brucella spp. (ভেড়ার ক্ষেত্রে Brucella melitensis ও Brucella ovis) দ্বারা হয়। 


এ রোগের ফলে গর্ভবতী ভেড়ার গর্ভাবস্থার শেষভাগে Abortion বা গর্ভপাত হয়। গর্ভচ্যুত বাচ্চা জীবিত থাকলেও খুব দুর্বল হয় অথবা জন্মের কয়েক ঘন্টা পরই মারা যায়। অনেক সময়ই গর্ভফুল আটকে যায় এবং পরবর্তীতে জরায়ুর প্রদাহ লক্ষ্য করা যায়। ফলশ্রুতিতে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে ভেড়ীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। আবার দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ থেকে দুধ উৎপাদন হ্রাস, বন্ধ্যাত্ব এবং বার বার গরম হওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পায়। প্রজনন কাজে ব্যবহৃত পুরুষ ভেড়ার ও এ রোগ হয়ে থাকে। ব্রুসেলা জীবাণু সংক্রমণের ফলে পুরুষ ভেড়ায় অর্কাইটিস, এপিডিডাইমাইটিস ও অন্যান্য জনন অঙ্গ এবং গ্রন্থির প্রদাহের ফলে এসব অঙ্গ স্ফীত ও ব্যাথাপূর্ণ হয়ে উঠে। এই আক্রান্ত পুরুষ ভেড়া বা ভেড়ীর সাথে অনাক্রান্ত ভেড়ী বা ভেড়ার প্রজননের মাধ্যমে ব্রুসেলা জীবাণু ছড়াতে থাকে। তাছাড়াও একবার যদি কোন খামার ব্রুসেলোসিস দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে সম্পূর্ণ খামারেই এ রোগের বিস্তার হতে পারে।


তবে, এই ব্রুসেলোসিস এর সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে, আক্রান্ত প্রাণী থেকে মানবদেহে এ রোগের বিস্তার (Zoonotic Disease)। আক্রান্ত প্রানীর কাঁচা বা স্বল্প জ্বাল দেয়া দুধ পান, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরন, মল-মুত্র অথবা দেহ নিঃসৃত অন্যান্য পদার্থের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ (কসাই, প্রানী প্রজননকর্মী বা চিকিৎসক) সংস্পর্শ থেকে মানুষ ও শিশুদের এ রোগ হতে পারে।  ব্রুসেলোসিস সংক্রমিত মানবদেহে পেশী ও জয়েন্টে প্রদাহ, দৈহিক দুর্বলতা, মাথা-ধরা, প্লীহা ও যকৃতের আকার বেড়ে যাওয়া, জ্বর উঠানামা করা ও রাতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া প্রভৃতি লক্ষণ প্রকাশ পায়। 

এই রোগের জীবাণু অন্তঃকোষীয় হওয়ায়, এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করেও তেমন ফল পাওয়া যায় না। তবে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ১০ মিলিগ্রাম/ কেজি দৈহিক ওজন হিসেবে ৩-৪ দিন এবং স্ট্রেপ্টোমাইসিন ৫ মিলিগ্রাম/ কেজি দৈহিক ওজন হিসেবে প্রত্যেহ একবার করে ৫ দিন ভেড়ার মাংসপেশীতে দিলে উপকার পাওয়া যায়।

ব্রুসেলোসিস নিয়ন্ত্রনের জন্য আক্রান্ত প্রাণী সনাক্তকরন ও মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলা (আক্রান্ত প্রানীর জন্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র, এবং নিঃসৃত পদার্থসহ) সবচেয়ে উত্তম। এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিন কোরিয়া বিভিন্ন ভ্যাকসিন বা টীকা (ব্রুসেলা মেলিটেনসিস স্ট্রেইন – ১৯, লাইভ ভ্যাকসিন) ব্যবহার করলেও বাংলাদেশে এখনো এ রোগের জন্য কোনো ভ্যাকসিন দেয়া হয় না। বাংলাদেশেও উক্ত ভ্যাকসিন ব্যবহার করে আমাদের প্রানীস্বাস্থ্য ও মানবস্বাস্থ্যের বিভিন্ন ক্ষতিসাধন থেকে মুক্তিসহ প্রানীসম্পদের এই সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়ন সম্ভব।


সূত্রসমুহঃ
DLS, 2014. Brucellosis in Bangladesh. www.dls.gov.bd/
http://bn.banglapedia.org
Rahman, M.S., Faruk, M.O., Her, M., Kim, J.Y., Kang, S.I., & Jung, S.C Prevalence of brucellosis in ruminants in Bangladesh; Veterinarni Medicina, 56, 2011 (8): 379–385.
A textbook of “Animal Husbandary and Veterinary Science”, V-II; by Professor M. A. Samad.

সম্ভাবনাময় শিল্প - খরগোশ পালন @ Rabbit Rearing An Emerging Industry



খরগোশ নামটি মনে এলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে লোমশ, তুলতুলে ও চটপটে ছোট একটি প্রাণীর ছবি। খরগোশ বা শশক স্তন্যপায়ী প্রাণীবর্গ Lagomorpha এর Leporidae গোত্রের তৃণভোজী সদস্য। প্রায় ৫২ প্রজাতির খরগোশের মধ্যে নিউজিল্যান্ড (সাদা, লাল, কালো), ডার্ক গ্রে (দেশী), ডাচ, ছিনছিলা, ফ্লোরিডা (সাদা) উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে খরগোশকে সাধারণত পোষা-প্রানী হিসেবে বা শখের বশে পালন করা হলেও বাণিজ্যিকভাবে দ্রুত বর্ধনশীল ও অধিক উৎপাদনশীল খরগোশ পালন বেশ লাভজনক। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য-চাহিদা ও খাদ্য-নিরাপত্তাসাধনের জন্য নতুন নতুন খাদ্য উৎস সন্ধান, সংযোজন ও উৎপাদন প্রয়োজন। ক্ষুদ্র বা বৃহৎ পরিসরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে অল্প পুঁজি ও স্বল্প পরিসরে যে কেউ, যেমন বাড়ির মহিলা বা ছোট ছেলে-মেয়েরাও কাজের ফাঁকে ফাঁকে খরগোশ পালন করে লাভবান হতে পারে। বিশ্বের বহু দেশ (যেমন – ইটালি, ফ্রান্স, চীন, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি) যেখানে খরগোশ পালন, উৎপাদনের মাধ্যমে আমিষের চাহিদা পূরণ করে এবং বাজারজাত করে আর্থিকভাবে প্রচুরভাবে লাভবান হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে এর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন একদমই নগণ্য।

খরগোশ পালনের জন্য  যে তথ্যগুলো জানা প্রয়োজনীয়-

খরগোশের শারীরবৃত্তীয় তথ্যসমূহ


  • জীবনকাল ৬-১৩ বছর
  • পানি গ্রহণের পরিমাণ ৫০ – ১০০ মিলি/কেজি/২৪ঘন্টা
  • খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ৯০- ৩০০গ্রাম/২৪ ঘণ্টা
  • তাপমাত্রা ১০৩.৩ – ১০৪০F
  • হৃদ স্পন্দন হার ১৩০ - ১৫০ /মিনিট
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের হার ৩২ -৬০ /মিনিট
  • প্রজনন ক্ষমতা অর্জন ৪-৮ মাস ( জাত ভেদে ৫-৮ মাস)
  • গর্ভাবস্থা নির্ণয় প্রজননের ১০-১২ দিন পর পাল্পেশনের মাধ্যমে
  • গর্ভধারণকাল ৩০-৩২ দিন
  • নবজাতক (প্রতিবারে বাচ্চা প্রদানের) সংখ্যা ২-৮ টি
  • নবজাতকের ওজন ৪০-১০০গ্রাম
  • চোখে দেখা শুরু করে ৭ দিন বয়সে
  • মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ে ৪-৬ সপ্তাহ বয়সে


দেশের সব জায়গায় হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগলের বা ব্রয়লার খামারের মতো খরগোশ পালন করেও লাভ করা সম্ভব। খরগোশ পালন করে মহিলারা বেশি লাভবান হতে পারেন। বাড়ির আশ-পাশ থেকে ঘাস, লতা-পাতা, শাকসবজি, তরকারির ফেলনা অংশ ইত্যাদি সংগ্রহ করে খরগোশ পালন এবং ব্যবসা করা যায়। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে খরগোশ ছেড়ে পালন করা হলেও বাড়িতে অল্প জায়গায় খাঁচা তৈরি করেই খরগোশ পালন করা যায়। বহুতল বিশিষ্ট খাঁচায় বাণিজ্যিকভাবেও খরগোশ প্রতিপালন করা যায়। 

আমাদের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুসারে খরগোশ পালনের প্রধান প্রধান সুবিধা গুলো হলঃ


  1.   খরগোশ খুব দ্রুত বর্ধণশীল প্রাণী এবং তাদের খাদ্য দক্ষতা (FCR) অপেক্ষাকৃত ভাল।
  2.   বাড়ির ছাদ বা আঙ্গিনাতে অল্প জায়গাতেই এটি পালন করা যায়।
  3.   খরগোশ তৃণভোজী প্রানী, রান্না ঘরের উৎচ্ছৃস্ট, খড়, ঘাস, আগাছা, শাক-সবজি প্রভৃতি তার স্বাভাবিক খাবার বিধায় খাদ্যর যোগান দেয়া সহজ।
  4.   খরগোশের মাংস নরম, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর, এতে ফ্যাট, কোলেস্টেরল ও সোডিয়ামের পরিমান কম (এমনকি মুরগীর মাংস থেকেও কম) থাকে তাই হার্টের রোগীকেও খাওয়ানো যায়।
  5.   ধর্মীয়ভাবেও যেকোন গোত্রের মানুষের জন্য খরগোশের মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। 
  6.   পবিত্র হাদীস শরীফের ছহীহ্ কিতাবে বর্ণিত রয়েছে যে, “হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খরগোশের গোশ্ত হাদিয়া দিলে তিনি তা গ্রহণ করেছেন, খেয়েছেন এবং খেতেও বলেছেন।” এ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, খরগোশের গোশ্ত খাওয়া কেবল হালালই নয় বরং সুন্নতেরও অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য, খরগোশের পা হরিণ বা গরু-ছাগলের মতো হোক কিংবা বিড়ালের মত হোক উভয় প্রকার পা বিশিষ্ট খরগোশই খাওয়া সম্পূর্ণ হালাল বলে ফতওয়া দেয়া হয়েছে। আর এটা শুধু হানাফী মাযহাবেই নয় বরং হানাফী, শাফেয়ী, হাম্বলী, মালেকী প্রত্যেক মাযহাবেই হালাল বলে ফতওয়া দেয়া হয়েছে – (তালীফায়ে রাশিদিয়া-পৃষ্ঠা-৪৫০)।
  7.   একটি প্রাপ্তবয়স্ক মা খরগোশ প্রতিবার ৪-৮ টি বাচ্চা দেয় এবং বছরে ৪-৫ বার বাচ্চা দেয়।
  8.   অন্যান্য পশু-পাখি পালন,পরিবহন ও চিকিৎসার খরচের তুলনায় এদের প্রতিপালন অনেক সহজ। 
  9.   এছাড়া খরগোশের চামড়া ও পশম মূল্যবান, এবং এর পায়খানাও ভালো জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
  10.   পারিবারিক শ্রমেই সফলভাবে খরগোশ পেলে লাভবান হওয়া যায়।



খরগোশ প্রতিপালনের জন্য বাড়ীর আঙ্গিনা বা বারান্দায় অল্প জায়গায় অথবা বাড়ীর ছাদে অল্প বিনিয়োগ করে ছোট আকারের শেড তৈরি করে খরগোশ প্রতিপালন করা যায়।
সাধারনত দুইটি পদ্ধতিতে খরগোশ প্রতিপালন করা যায়- 


1) লিটার পদ্ধতিঃ এই পদ্ধতিটি কম সংখ্যক খরগোশ পালনের জন্য উপযোগী। মেঝেতে মাটি খুঁড়ে গর্ত বানানো বন্ধ করার জন্য মেঝে কংক্রিটের হওয়া উচিত। মেঝের উপর ৪-৫ ইঞ্চি পুরু করে তুষ, ধানের খড় অথবা কাঠের ছিলকা ইত্যাদি ছড়িয়ে দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে এক সাথে ২৫টার বেশি খরগোশ প্রতিপালন করা ঠিক নয়। পুরুষ খরগোশ আলাদা ঘরে রাখা উচিত। অবশ্য এভাবে প্রতিপালন করলে খরগোশ সহজে রোগাক্রান্ত হতে পারে। তাছাড়া খরগোশকে সামলানোও খুব

অসুবিধা হয়।
2) খাঁচা পদ্ধতিঃ বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ প্রতিপালনের জন্য লোহার পাত দিয়ে তৈরি ৩-৪ তাকবিশিষ্ট খাঁচা অধিক উপযোগী। প্রতিটি তাকে খরগোশের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা রেখে খোপ তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ খরগোশের জন্য ৪ বর্গফুট, পূর্ণবয়স্ক মা খরগোশের জন্য ৬ বর্গফুট (প্রসূতি ঘর সহ) এবং বাচ্চা খরগোশের জন্য ১.৫ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে সাধারণত পরিবহনযোগ্য নেটের খাঁচা বা কাঠের বাক্স খরগোশ প্রতিপালনের জন্য ব্যবহার করা হয় যা খামারীরা দিনের বেলায় ঘরের বাইরে এবং রাতে ঘরের ভিতরে আনতে পারে। এক্ষেত্রে ঘরের কোনো কোনা এলাকাতে পুরুষ এবং স্ত্রী খরগোশ একত্রে রাখা হয় কিন্তু বাচ্চা দেবার পর বাচ্চাসহ স্ত্রী খরগোশকে আলাদা করে ফেলা হয়। আবার কোনো কোনো এলাকায় স্ত্রী এবং পুরুষ খরগোশকে সবসময় আলাদা রাখা হয়। কেবলমাত্র প্রজননের সময় পুরুষ খরগোশকে স্ত্রী খরগোশের নিকট দেয়া হয়।

খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ
বয়স ও প্রজাতি ভেদে খরগোশের খাদ্য গ্রহণ ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হয়। একটি পুর্ণবয়স্ক খরগোশের খাদ্যে পুষ্টির জন্য ক্রুড প্রোটিন (CP) ১৭-১৮%, আঁশ (Fiber) ১৪%, খনিজ পদার্থ (Minerals) ৭% ও বিপাকীয় শক্তি (Energy) ২৭০০ কিলোক্যালরী/ কেজি হওয়া প্রয়োজন। প্রদেয় খাদ্যে পরিমাণ হিসেবে বয়স্ক খরগোশের জন্য প্রতিদিন ১৫০-২০০ গ্রাম, দুগ্ধবতী খরগোশের জন্য প্রতিদিন ২৫০-৩০০ গ্রাম ও বাড়ন্ত খরগোশের জন্য প্রতিদিন ৯০-১১০ গ্রাম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। 
খাদ্যের ধরণ নির্বাচনে সবুজ শাক-সবজি; যেমন- ঋতু ভিত্তিক সবজি, পালং শাক, গাজর, মুলা, শশা, শাকের উচ্ছিষ্টাংশ, সবুজ ঘাস ইত্যাদি ও দানাদার খাদ্যের ক্ষেত্রে চাল, গম, ভুট্টা, ছোলা, তৈলবীজ ইত্যাদি তবে, বাণিজ্যিকভাবে খরগোশ পালনের জন্য ব্রয়লার মুরগির জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্য খরগোশের রেশন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

খরগোশকে খাবার খাওয়ানোর নিয়ম-
নতুন খরগোশ কিনলে খরগোশটি কি ধরণের খাবার খায় তা জেনে কেনার আগের ১/২ সপ্তাহ যে ধরণের খাবার খেয়েছে সে ধরণের খাবার দিতে হবে, পরে আস্তে আস্তে অন্য খাবারের অভ্যাস করতে হবে। কম করে কিন্তু বারে বারে, কমপক্ষে দিনে ৩ বার, প্রতিদিন একই সময়ে খাবার দিতে হবে দিতে হবে। 

পরিষ্কার, শুকনা ও তাজা খাবার দিতে হবে। আগের না খাওয়া খাবার সরিয়ে ফেলতে হবে। বিভিন্ন ধরণের খাদ্যে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। হঠাৎ করে খাবার পরিবর্তন করা যাবে না এবং অবশ্যই খরগোশের থাকার আশেপাশে একটি পরিস্কার পাত্রে সবসময় খাবার পানি নিশ্চিত করতে হবে। 


খরগোশের প্রজননঃ
পুরুষ খরগোশ সাধারনত ৮ মাস বয়সে এবং স্ত্রী খরগোশ প্রজাতি ভেদে; ছোট প্রজাতি ৩-৪ মাস এবং বড় প্রজাতি ৮-৯ মাস বয়সে প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। যদিও খরগোশের গরম হওয়া বোঝা খুব কঠিন। হঠাৎ অস্থিরতা, খাচার সাথে শরীর ডলা, ভালভা ফুলা ও গোলাপী / বেগুনি রং ধারণ করা প্রভৃতি গরম হওয়ার লক্ষণ। প্রজননের সময় একটি পুরুষ খরগোশের সাথে ৩-৪টি স্ত্রী খরগোশ রাখা যেতে পারে তবে গর্ভবতী খরগোশকে পৃথক করে রাখা ভাল। মা খরগোশ সাধারণত গড়ে ৩০ দিন বাচ্চা পেটে রাখে। প্রতিবার বাচ্চা দেওয়ার এক মাসের মাথায় যৌন মিলন ঘটিয়ে বছরে কমপক্ষে ৫ বার বাচ্চা নেওয়া যায়। তবে বছরে ৮ বারের বেশি বাচ্চা নেওয়া উচিত নয়।

স্বাস্থ্য বিধিঃ
খরগোশের দাঁত ক্রমাগতই বাড়ে। তাই শুধুমাত্র এক প্রকার খাবার দিয়ে খরগোশ পালন অসম্ভব। গরমের দরুন খরগোশরা দিনের বেলায় খাবার নেয় না। কিন্তু রাত্রিবেলা ওরা সক্রিয় থাকে। তাই রাত্রিবেলা দেওয়া সবুজ খাবার ওরা নষ্ট না করেই খেয়ে নেয়। খরগোশ শীত সহ্য করতে পারলেও অত্যাধিক গরম সহ্য করতে পারে না। 
প্রজননের জন্য সবচেয়ে বেশি ওজন বিশিষ্ট খরগোশ নির্বাচন করতে হবে। কোন প্রকার অসুস্থ খরগোশকে প্রজনন করানো যাবে না। ১টি পুরুষ খরগোশকে সপ্তাহে ৩/৪ বারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না। বাচ্চা জন্ম দেয়ার জন্য একটি ছোট নেস্ট বক্স অথবা কিছু পরিষ্কার খড়কুটা দিতে হবে। বাচ্চা জন্ম দেয়ার জন্য শান্ত ও পরিছন্ন পরিবেশের দরকার হয়। জন্মের পর কোন মরা বাচ্চা থাকলে তা সরিয়ে নিতে হবে। বাচ্চার গায়ে হাত দিয়ে আদর করা ঠিক না। কারণ এতে বাচ্চার শরীরে অন্য গন্ধ হয় এবং এর ফলে মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে পারে। জন্মের পর ১ মাস মায়ের সাথে বাচ্চা রাখতে হবে, ১ মাস পর মা থেকে আলাদা করে কিন্তু পাশাপাশি রেখে আরও ২ মাস পালার পর খাওয়ার উপযুক্ত হয়। 
খরগোশের ঘর, খাঁচা, খাদ্য ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। খাঁচা, নেস্ট বক্স পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে অনেকক্ষণ রোদে রাখতে হবে। পরিষ্কার খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দিতে হবে। পিঁপড়া, ইঁদুর, ছুঁচো, শিয়াল ইত্যাদির আক্রমণ থেকে খরগোশকে রক্ষা করতে হবে। রোগাক্রান্ত্র খরগোশকে কখনই AMOXICILLIN জাতীয় ঔষধ দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে প্রানী চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

রোগ বালাইঃ
প্রাণী মাত্রই কিছুনা কিছু রোগ-বালাই আছে তবে অন্যান্য গৃহপালিত পশু-পাখির তুলনায় খরগোশের ক্ষেত্রে রোগ-বালাই কমই হয়। খরগোশ পরিচ্ছন্ন জায়গায় থাকতে বেশী পছন্দ করে। তাই ইহার ঘর সর্বদাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘরে ২৯ সেঃ এর বেশী তাপমাত্রা হলে পুরুষ খরগোশ অনুর্বর হয়ে যায়। এছাড়া খরগোশ কক্সিডিওসিস, গলাফুলা, পাস্তুরেলোসিস, সালমোনেলসিস ও কিছু পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়। অসুস্থ খরগোশের চোখ ফ্যাকাসে, কান খাড়া থাকেনা, লোম শুষ্ক ও রুক্ষ দেখায়, খাদ্য ও পানি খেতে অনীহা প্রকাশ করে, দৌড়াদৌড়ি কম করে, নাক/চোখ দিয়ে পানি পড়ে ও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যায়। ঘর সর্বদাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে ও নিয়মিত প্রতিষেধক প্রদানের মাধ্যমে প্রায় সকল রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রশিক্ষণঃ
খরগোশ পালনের ক্ষেত্রে প্রথমেই, যারা খরগোশ পালন করে তাদের কাছ থেকে খরগোশ পালনের বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। এছাড়া খরগোশ পালন সংক্রান্ত কোন তথ্য জানতে হলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রানীসম্পদ কর্মকর্তা অথবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্ধারিত ফি এর বিনিময়ে পশু পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

কর্মসংস্থান সম্ভাবনাঃ
খুব সহজেই যে কেউ খরগোশ পালনকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারেন। একটি প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশ বছরে ৫ থেকে ৬ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবার এরা ২ থেকে ৮টি বাচ্চা দেয়। এই হিসেবে বছরে একজোড়া খরগোশ থেকে গড়ে ৩২ থেকে ৪০টি খরগোশ হতে পারে। পাশাপাশি ৩ মাস অন্তর অন্তর এরা পূর্ণবয়স্ক হয়ে পুনরায় এদের থেকেই আবার বাচ্চা জন্ম নেয় এজন্যে অবশ্য পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা রাখতে হয়। ছয় মাস বয়সী ১০০টি স্ত্রী খরগোশের সঙ্গে ছয় মাস বয়সী ২৫-৩০টি পুরুষ খরগোশের মিলনের ফলে আড়াই থেকে তিন মাসে গড়ে ৫০০-৬০০টি বাচ্চা পাওয়া সম্ভব। ছয় মাস বয়সী প্রতিটি খরগোশের মূল্য ৩৫০-৫০০ টাকা (বর্তমান বাজার দরে)। প্রতিটি বাচ্চা এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে বিক্রির উপযোগী হয়। তখন এদের প্রতিটির মূল্য দাঁড়ায় ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরগুলোতে খরগোশ কেনাবেচা হয়। খরগোশ সবুজ ঘাস, লতাপাতা, শাক-সবজি, ভাত খেতে এরা খুব পছন্দ করে। সামান্য কিছু দানাদার খাবার এবং বাড়ীর আশেপাশের ঘাস, লতা-পাতা এবং ঘরের উচ্ছিষ্টাংশ প্রদান করে পারিবারিকভিত্তিতে ২০ -২৫ টি খরগোশ প্রতিপালন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের সাথে সাথে মাসিক ৫০০০ - ৬০০০ টাকা আয় করা সম্ভব যা অন্য কোনো ভাবে সম্ভব নয়। এক কাঠা জায়গায় কমপক্ষে ১২০টি খরগোশ পালন সম্ভব। গড় হিসেবে দেখা গেছে আটশো থেকে এক হাজার টাকার একজোড়া ছয়মাস বয়সী বাচ্চা কিনে বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। মাংস হিসেবেও এটি যথেষ্ট চাহিদাসম্পন্ন। বিদেশে এর মাংস ও চামড়া রপ্তানি করেও আয় করা সম্ভব।



গবাদি প্রাণী মোটাতাজাকরণ @ Beef Fattening


বাংলাদেশে মাংস বা গোস্ত ছাড়া বিভিন্ন উৎসব পালন, চিন্তা করাই যেনো অমূলক। কিছুদিন পরই আসছে ঈদ-উল-ফিতর এবং এর পর ঈদ-উল-আযহা। এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন উৎসবের প্রধান উপাদান হল মাংস, সেক্ষেত্রে বিয়ে, মাহফিল, ঈদ তথা কোরবানির মাংসের মূল উৎস হচ্ছে গরু। আর সেটা যদি হয় মোটাতাজা ও সু-স্বাস্থ্যবিশিষ্ট তবে স্বাচ্ছ্যন্দের সীমা থাকে না। এইসব উপলক্ষকে সামনে রেখে যারা গরু মোটাতাজাকরণে আগ্রহী তাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া দরকার। গরু মোটাতাজাকরণ বা বীফ ফ্যাটেনিং (Beef Fattening) বলতে এক বা একাধিক গরু বা বাড়ন্ত বাছুরকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উন্নত সুষম খাবার সরবরাহ করে এবং  বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ঐ গরুর শরীরে অধিক পরিমাণ মাংস/চর্বি বৃদ্ধি করে বাজারজাত করাকেই বুঝায়। বয়সের ওপর ভিত্তি করে সাধারণত ৯০ দিনের মধ্যে গরু মোটাতাজাকরণ করা যায় তবে অনেক সময় পরিস্থিতিভেদে ১২০-১৪০ দিনও লাগতে পারে। গরু মোটাতাজাকরণের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় হচ্ছে বর্ষা এবং শরৎকাল যখন প্রচুর পরিমাণ কাঁচা ঘাস পাওয়া যায়। দেশের মাংসের ঘাটতি পূরণ ও বর্ধিত জনসংখ্যার কাজের ব্যবস্থা করতে বাণিজ্যিকভাবে গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ঈদের কিছুদিন আগ থেকে গরুকে উন্নত খাদ্য ও ব্যবস্থাপনা দিয়ে মোটাতাজাকরণ লাভজনক। এজন্য দরকার গরু মোটাতাজাকরণে সঠিক ব্যবস্থাপনা। তাই এটি কখন ও কিভাবে করলে বেশি লাভবান হওয়া যায় তার আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক  পদ্ধতি নিম্নে আলোচনা করা হলো-

গরু মোটাতাজাকরণের সুবিধাসমূহঃ

  • স্বল্প টাকা বিনিয়োগ করে অল্প সময়ে লাভসহ মূলধন ফেরত পাওয়া যায়।
  • দেশী এবং শংকর দুই জাতের গরুই মোটাতাজাকরণে ব্যবহার করা যায়।
  • গরুর খামার তৈরির জন্য খুব বেশি শ্রমিক এবং দক্ষ অভিজ্ঞ শ্রমিকেরও প্রয়োজন হয় না।
  • এ ধরণের খামারের জন্য বেশি জমিরও প্রয়োজন হয় না।
  • স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প হওয়ার কারণে পশু মৃত্যুর হার কম।
  • বেকার যুবকদের ও মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
  • কৃষিকার্য থেকে উৎপাদিত উপজাত, খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে সহজেই অধিক মাংস উৎপাদন করা যায়।


মোটাজাতকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয়সমুহঃ

ক. গরু নির্বাচনঃ
বিশুদ্ধ জাতের গরু অপেক্ষা সংকর (CROSS) জাতের গরুর শারীরিক বৃদ্ধি তাড়াতাড়ি হয় বলে সংকর জাতের গরু নির্বাচন করা ভালো। তবে দেশীয় গরু মোটাতাজাকরণও লাভজনক।
দুই-আড়াই (২-২.৫) বছরের গরুর শারীরিক বৃদ্ধি ও গঠন মোটাতাজাকরণের জন্য বেশি ভালো।
এঁড়ে বাছুরের দৈহিক বৃদ্ধির হার বকনা বাছুরের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
বাছুরের শিরদাঁড়া সোজা, বুক চওড়া ও ভরাট, পেট চ্যাপ্টা ও বুকের সঙ্গে সমান্তরাল, মাথা ছোট ও কপাল প্রশস্ত, চোখ ভেজা ও উজ্জ্বল, পা খাটো প্রকৃতির ও হাড়ের জোড়াগুলো স্ফীত, পাঁজর প্রশস্ত ও বিস্তৃত হতে হবে।
কালো ও গাঢ় লাল রঙের গরু বাছাই করতে হবে। এতে বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাবে।
ঢিলে চামড়া বিশিষ্ট, পাতলা অথচ সুস্থ রোগহীন গরু বাছাই করতে হবে।
তবে...কেনার পর গরুর শরীরে কোনো ক্ষত থাকলে সে স্থানে পভিসেপ বা স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করে তা না শুকানো পর্যন্ত নেগোভোন মলম লাগিয়ে প্রয়োজনে ব্যাণ্ডেজ করে রাখতে হবে, যাতে ক্ষত স্থানে মশা-মাছি কিংবা ময়লা জমতে না পারে। ক্ষত সেরে যাওয়ার পর গরুর গায়ের সেসব পরজীবী যেমন-উকুন, আঠালি, সিঁদুর পোকা ইত্যাদি মুক্ত করতে হবে।

খ. স্থান নির্বাচনঃ
গরুর আবাসস্থল স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হচ্ছে- শুষ্ক ও উঁচু জায়গা হতে হবে, যাতে খামার প্রাঙ্গণে পানি না জমে থাকে; খোলামেলা ও প্রচুর আলো-বাতাসের সুযোগ থাকতে হবে। ঘরের মেঝে ইট বিছানো বা পাকা হতে পারে তবে মসৃণ করা যাবে না। কাঁচা মেঝেতেও গরু পালন করা যায়। ঘরের মেঝের একদিকে ঢালু করতে হবে যাতে গোবর ও মুত্র ড্রেন দিয়ে দূরে গর্তে ফেলা যায়। খামারে কাঁচামাল সরবরাহ ও উৎপাদিত দ্রব্যাদি বাজারজাতকরণের জন্য যোগাযোগ সুবিধা থাকতে হবে। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকতে হবে। সুষ্ঠু নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেমন- পানি, মলমূত্র, আবর্জনা ইত্যাদি। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে সম্প্রসারণের সুযোগ থাকতে হবে।

গ. বাসস্থানের গঠনঃ
 গরুর বাসস্থান তৈরির জন্য খোলামেলা উঁচু জায়গায় ঘর তৈরি করা প্রয়োজন। একটি গরুর জন্য মাপ হতে হবে কমপক্ষে ১০-১২ বর্গফুট। মাঝারী আকারের গরুর জন্য ৫-৬ ফুট দৈর্ঘ্য X ৩-৪ ফুট প্রস্থ ও ঘরের উচ্চতা ৮-১০ ফুট হওয়া দরকার। ভিটায় ১ ফুট মাটি উঁচু করে এর ওপর ১ ফুট বালু দিয়ে ইট বিছিয়ে মেঝে মসৃণ করার জন্য সিমেন্ট, বালু ও ইটের গুঁড়া দিতে হবে। গরুর সামনের দিকে চাড়ি এবং পেছনের দিকে বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য নালা তৈরি করতে হবে। বাঁশের খুঁটি দিয়ে বেঁধে ওপরে ধারি অথবা খড় ও পলিথিন দিয়ে চালা দিতে হবে, ঘরের পাশে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা দরকার। পাশাপাশি দাঁড়ানো গরুকে বাঁশ দিয়ে আলাদা করতে হবে যাতে একে অন্যকে গুঁতা মারতে না পারে। ঘরের চারপাশ চটের পর্দার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে অতি বৃষ্টি ও অতি ঠান্ডার সময় ব্যবহার করা যায়।

ঘ. খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ
জীবন ধারনের জন্য খাদ্য অত্যাবশ্যক। গরু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে খাদ্যে মোট খরচের প্রায় ৬০-৭০ ভাগ ব্যয় হয়। তাই স্থানীয়ভাবে খরচ কমানো সম্ভব। এজন্য গরু মোটাতাজাকরণের একটি সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিচে দেয়া হলো-
শুকনা খড়ঃ দুই বছরের গরুর জন্য দৈহিক ওজনের শতকরা ৩ ভাগ এবং ২ এর অধিক বয়সের গরুর জন্য শতকরা ২ ভাগ শুকনা খড় ২-৩ ইঞ্চি করে কেটে এক রাত লালীগুড়/চিটাগুড় মিশ্রিত পানিতে (পানি : চিটাগুড়=২০:১ ) ভিজিয়ে প্রতিদিন সরবরাহ করতে হবে।
কাঁচা ঘাসঃ প্রতিদিন ৬-৮ কেজি তাজা ঘাস বা শস্য জাতীয় তাজা উদ্ভিদের উপজাত দ্রব্য যেমন- নেপিয়ার, জার্মান,পারা, খেসারি, দেশজ মাটি কলাই, দুর্বা ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে।
দানাদার খাদ্যঃ   প্রতিটি গরুকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১-২ কেজি দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। নিচে ১ কেজি দানাদার খাদ্যের তালিকার একটি নমুনা দেয়া হলো-
উপাদান দানাদার খাদ্য মিশ্রণের পরিমাণ শতকরা হার
গম ভাঙা-গমের ভুসি ৪০০ গ্রাম ৪০%
চালের কুড়া ২০০ গ্রাম ২০%
তিলের খৈল ১৫০ গ্রাম ১৫%
খেসারি বা ছোলা অথবা যে কোনো ডালের ভুসি ১৫০ গ্রাম ১৫%
হাড়ের গুড়া/ঝিনুক গুড়া ৫০ গ্রাম ৫%
লবণ ৫০ গ্রাম ৫%
মোট ১০০০ গ্রাম =১ কেজি ১০০%
উল্লিখিত তালিকা ছাড়াও বাজারে প্রাপ্ত ভিটামিন মিনারেল মিশ্রণ (যেমন- Ranmix Total®), এন্টিবায়োটিক (যেমন- Oxysentin® ২০% @ ১গ্রাম/কেজি) ও বাজারে প্রচলিত খাবার সোডা, ১% হারে খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন রকমের ইউরিয়া মোলাসেস ব্লকও ব্যবহার করা যেতে পারে।

গরুকে সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে মিশ্রিত উন্নত খাবার দিতে হবে-
১। আঁশ বা ছোবড়া জাতীয় জাতীয়-খাদ্যের সাথে মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে
২। দানাদার জাতীয়-খাদ্যের সাথে সরাসরিভাবে এবং
৩। ইউরিয়া মোলাসেস ব্লকের মাধ্যমে ।

খড়ের সাথে মিশিয়ে ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়মঃ ১০ কেজি খড় (ইউ.এম.এস.) প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ৫ লিটার পানি, চিড়াগুড় ২.৫ কেজি  এবং ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া পলিথিনের উপর বা পাকা মেঝের উপর স্তরে-স্তরে সাজিয়ে ভালভাবে  উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে সমস্ত উপাদান মেশাতে হবে, যা একবারে বা সংরক্ষণ করে ২-৩ দিনের মাঝে খাইয়ে শেষ করতে হবে। গরুকে প্রথমে দৈনিক ৫ গ্রাম থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০-৬০ গ্রাম ইউরিয়া খাওয়ানো যায়। ছোট গরুর ক্ষেত্রে ৩০-৪০ গ্রামের বেশী দৈনিক খাওয়ানো উচিত নয়। দানাদার খাদ্যে ইউরিয়া ব্যবহার করে ১০০ কেজি দৈহিক  ওজনের গবাদি পশুর দৈনিক খাদ্যের তালিকা নিন্মরুপ-

  • ধানের খড় = ২ কেজি
  • সবুজ ঘাস = ২ কেজি (ঘাস না থাকলে খড় ব্যবহার করতে হবে )
  • দানদার খাদ্যে মিশ্রন = ১ - ২ কেজি
  • ইউরিয়া = ৩৫ গ্রাম (নিয়মানুযায়ী)
  • চিটাগুড়া = ২০০-৪০০ গ্রাম
  • লবণ = ২৫ গ্রাম

দানাদার খাদ্যের সাথে লবন, ইউরিয়া, চিটাগুড় এক সাথে মিশিয়ে দিনে ২ বার দিতে হবে। ধানের খড় এবং কাঁচা ঘাস ছোট ছোট করে কেটে এক সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
খাওয়ানের পরিমানঃ  প্রতিটি গরুকে তার দেহের ওজন অনুপাতে দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। গরুর ওজনের শতকরা ২-৩ ভাগ পরিমাণ খাবার (Dry Matter) সরবরাহ করলেই চলবে।
খাওয়ানোর সময়ঃ গরুকে দানাদার মিশ্রণটি এবারের না খাইয়ে ২ ভাগে ভাগ করে সকালে এবং বিকালে খাওয়াতে হবে।

পানিঃ প্রতিটি গরুকে পর্যান্ত পরিমানে পরিস্কার খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে।
এছাড়াও মোটাতাজা করনের গরুকে সর্বক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশ জাতীয় খাবার (খড়, কাঁচা ঘাস) এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। গবাদীপশুকে ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খাবার প্রদানে কিছু কিছু সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত।

  • এক বছরের নিচে গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না।
  • কখনও মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না
  • অসুস্থ গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না, তবে দূর্বল গরুকে পরিমাণের চেয়ে কম খাওয়ানো যেতে পারে।
  • ইউরিয়া খাওয়ানোর প্রাথমিক অবস্থা (৭ দিন পর্যন্ত পশুকে ঠান্ডা ছায়াযুক্ত স্থানে বেঁধে রাখতে হবে এবং ঠান্ডা পানি দিয়ে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। প্রকল্প মেয়াদ তিন মাস, শুরু হবে ইউরিয়া মিশ্রিত খাবার প্রদানের দিন থেকে।


এই খাবার খাওয়ানো শুরুর ১০-১৫ দিন পর ইনজেকশন Catophos® বা Catopen®  (১৫-২০ মিলি করে) মাংসপেশীতে প্রতি ১৪ দিন পরপর প্রয়োগ করলে মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
উল্লেখিত তিনটি পদ্ধতির মধ্যে খড়ের প্রক্রিয়াজাত করে ইউরিয়া খাওয়ানো সহজ, ব্যয় কম এবং ফল ভালো আসে। এই প্রকল্পগুলো বিভিন্ন বয়সী হতে পারে। যেমন ৩ বা ৪ মাস মেয়াদি। নির্ভর করছে খামারি কেনা গরুটি কি রকম মোটা করে কি দামে বিক্রি করবেন। দাম বেশি চাইলে প্রকল্প মেয়াদ দীর্ঘ হবে এবং কম চাইলে প্রকল্প মেয়াদ স্বল্প হবে। তবে অনেকেই ঈদের বাজারকে চিন্তা করে তার ৪/৫ মাস আগে থেকে প্রকল্প শুরু করেন।

ঙ. অন্যান্য প্র্যয়োজনীয় তথ্যাবলীঃ
গরু কেনার পরপরই, একটি গরুর জন্য Negopox® পাউডার প্রতি কেজি পানিতে ১/২ চা চামচ মিশাতে হবে। তারপর বসতি থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে প্রথমে ভালোভাবে নিজের নাক-মুখ বেঁধে, গরুর কান, চোখ, মুখ ছাড়া লেজের গোড়া, শরীরের সঙ্গে পায়ের সংযোগস্থলসহ সকল সংকীর্ণ জায়গায় এবং গোয়ালের সর্বত্র ওষুধ মিশ্রিত পানি দিয়ে ভিজিয়ে বা লাগাতে হবে। ওধুষ লাগিয়ে ২০-২৫ মিনিট অপেক্ষা করার পরে পরিস্কার পানি দ্বারা শরীরের সর্বত্র ভালোভাবে ধুয়ে ওষুধমুক্ত করতে হবে। ওষুধ লাগানোর ২/১ দিন পর যদি দেখা যায় ভালোভাবে বাহ্যিক পরজীবী মুক্ত হয়নি তবে ১৫ দিন পরে আবার একই নিয়মে ওষুধ লাগাতে হবে।
সর্তকতা-

  • যে ব্যক্তি ঔষুধ লাগাবেন, তিনি গরুর শরীরের ক্ষতস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকবেন, কারণ এই ঔষুধ বিষ জাতীয়।
  • গরুর শরীরে ক্ষতস্থানকে (যদি ভালোভাবে না শুকিয়ে থাকে) এড়িয়ে ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।
  • গরুকে ঔষুধ প্রয়োগের পর ভালোভাবে গোসল করিয়ে উক্ত স্থান থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে মুখের বাঁধন খুলতে হবে কারণ গরু স্বভাবত ঔষুধ লাগা ঘাস বা পানি খেয়ে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।


কৃমিমুক্তকরন  : পশু ডাক্তারের নির্দেশনা মত কৃমির ঔষধ ব্যবহার করতে হবে। গরু সংগ্রহের পর পরই পালের সব গরুকে একসাথে কৃমিমুক্ত (বিশেষ করে গোল কৃমি ও কলিজা বা পাতা কৃমি) করা উচিত। তবে প্রতি ৭০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ টি করে ENDEX® বা LT-Vet® টাবলেট অথবা প্রতি ১২০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ টি Tetranid®  ব্যবহার  করা যেতে পারে।
টিকা প্রদান : পূর্ব থেকে টিকা না দেওয়া থাকলে খামারে আনার পরপরই সবগুলো গরুকে তড়কা, বাদলা এবং ক্ষুরা রোগের টিকা দিতে হবে। এ ব্যপারে নিকটস্থ পশু হাসপাতলে যোগাযোগ করতে হবে।

রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা : কেনার পর গরুকে ৭ দিন আলাদা রাখতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পশুর গোসল করাতে হবে। গোশালা ও পার্শ্ববর্তী স্থান সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে। নিয়মিতভাবে গরুকে কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে। বাসস্থান সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পরিমিত পরিমাণে পানি ও সুষম খাদ্য প্রদান করতে হবে। রোগাক্রান্ত পশুকে অবশ্যই পৃথক করে রাখতে হবে। খাবার পাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। খামারের সার্বিক জৈব নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে। পশু জটিল রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

কোনোভাবেই কোনো গ্রোথ হরমোন (Dexamethasone জাতীয় ঔষধ) ব্যবহার করে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না। এসব ঔষধের ব্যবহার ছাড়াও স্বাভাবিক ও জৈব পদ্ধতিতেই গরু মোটাতাজাকরণ সম্ভব। এজন্য দরকার শুধু কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা।
বাজারজাতকরণ : মোটাতাজাকরণ গরু লাভজনকভাবে সঠিক সময়ে ভালো মূল্যে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ হচ্ছে আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়। বাংলাদেশে মাংসের জন্য বিক্রয়যোগ্য গবাদিপশুর বাজার মূল্যেও মৌসুমভিত্তিক হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। কাজেই একজন প্রতিপালককে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য অবশ্যই গরুর ক্রয় মূল্য যখন কম থাকে তখন গরু ক্রয় করে বিক্রয় মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে বিক্রয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণত কোরবানির ঈদের সময় গরুর মূল্য অত্যধিক থাকে এবং এর পরের মাসেই বাজার দর হ্রাস পায়। তাই এখন গরু মোটাতাজাকরণের উপযুক্ত সময়। তবে গরু বিক্রির কমপক্ষে ২ সপ্তাহ আগে থেকে সব ধরনের ভিটামিন ও এন্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। স্বল্প সময়ে অধিক লাভবান হওয়ার সহজ এবং সুবিধাজনক উপায়ের মধ্যে গরু মোটাতাজাকরণ একটি অত্যন্ত যুগোপযোগী পদ্ধতি। তাছাড়া বর্তমানে সারাবছরই মাংসের বাজার দর স্থিতিশীল থাকায় গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলে লাভবান হওয়া যায়। স্থানীয় হাট-বাজার ও শহরে গরুর মাংসের চাহিদা খুব বেশি।


দৈহিক ওজন নির্ণয়ঃ মোটাতাজাকরন প্রক্রিয়ায় গরুকে দৈহিক ওজন নির্ণয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা গরুর খাদ্য সরবরাহ,ঔষধ সরবরাহ ইত্যাদি কাজগুলো করতে হয় দৈহিক ওজনের ভিত্তিতে। গরুর ওজন নির্নয়ের জন্য গরুকে সমান্তরাল জায়গায় দাড় করাতে হবে এবং ছবির নির্দেশিকা মোতাবেক ফিতা দ্বারা দৈর্ঘ্য (L) ও বুকের বেড়ের (G) মাপ ইঞ্চিতে নিতে হবে। এই মাপ   (L ×G^2)/৬৬০=ওজন (কেজি) সূত্রে বসালে গরুর ওজন পাওয়া যাবে


প্রশিক্ষণঃ গরু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে এ পদ্ধতির বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। এছাড়া গরু মোটাতাজাকরণ সংক্রান্ত কোন তথ্য জানতে হলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অথবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা পর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্ধারিত ফি এর বিনিময়ে পশু পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

Compiled by: Dr. Md. Kumrul Hassan